সুদীপ রায় সুমনের দুইটি ছোটগল্প

পুড়িয়া


শরীর হাতড়ে কিছু খোঁজার চেষ্ঠা করছে একজন পুলিশ। দুইজন শতর্ক চোখে তাকিয়ে আমার দিকে। আর একজন প্রশ্ন করে চলে,
- বাসা কোথায়?
- সামনেই।
- কোথা থেকে আসছেন?
- শম্ভুগঞ্জ থেকে।


- কি করেন ?
- অর্থ উপার্জন হয় এমন কিছু করি না।

- নাম কি?

নাম বলতে যাচ্ছি অমনি আমার পাঞ্জাবীর ডান পকেট থেকে সাদা কাগজের একটা ছোট পুড়িয়া বের করলো পুলিশ। আমি নির্বিকার, পুলিশের চোখ যেন বিস্ফোরিত! ভাবের সাথে জিজ্ঞেস করে,
- এই বেটা, ক'যে 'বেকার'। অতো ভাব চোদাস্ ক্যান?

আমি তখনো নির্বিকার। পুড়িয়া'টা হাতে চেপেই সব বুঝে ফেলার অভিব্যক্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করে,
- কই থেইকা আনছস্?
- শম্ভুগঞ্জ থেকেই।

- কার থেইকা আনছস, নাম ক'?
- হাসান।

- নাম্বার দে।
- এর সাথে হাসানের নাম্বার দেবার কী সম্পর্ক?

- দুইডা থাপ্পর লাগাইলেই বুঝবি। নাম্বার দে।

অন্যজন বলে, তোমার নাম্বার থেইকাই কল দেও। নাম্বার চাপতেই মোবাইল ফোন কানে লাগায় আগেরজন। ওপাশ  থেকে হাসানের কন্ঠ,
- দাদা কও।
- দাদা না, পুলিশ। তোর নাম হাসান?

- জী। কী হয়েছে দাদার?
- এইটা দেখার জন্য এখনি ব্রীজে আয়, নয়তো পাঁচ মিনিট পরে বাসার লোকসহ তোরে ধইরা নিয়া আমু।

- করলাম'টা কি বলবেন তো?
- ঐ..., তোরে যেইডা কইছি হেইডা কর।
বলে লাইন কেটে দেয়। ফের হাসানের কল। আমি কেটে দিই। ২ মিনিট পর মোবাইল ফোনে এস.এম.এস. আসে হাসানের। জানায়, আমি ছোটন আর বাদল ভাই'কে নিয়ে আসতাছি। ছোটন ভাই কইছে কোনো সমস্যা হবে না, ওয়েট।

এর মাঝেই একজন পুলিশ জিজ্ঞেস করে,
- কবে থেইকা খাস?
- কি?

- ভদ্রভাবে কইতাছি তো- কানে বাতাস ঢোকে না! কয়েক'টা লাগাইলেই ... !
- ভাই, কোথাও ভুল হচ্ছে! বিষয়'টা...

- বিষয়'টা তোর কাছ থেইকা বুঝতে হইবো! বিরাট মুসুল্লি ভাব ধরছস, ভাবছস কিছু বুঝিনা! এই, এ্যারে হাতকড়া লাগান।

এর মাঝেই মজনুর ফোন। একটু সময় চেয়ে ফোনটা ধরি,
- আপনি এখনো ব্রীজে?
- হ্যাঁ।

- মঞ্জিল'রে নিয়া ওর বাইকে আইতাছি। বাইকের কাগজ হয় নাই, তাই মঞ্জিল ব্রীজের এই পাড়েই থাকবে। ব্রীজ হাঁইটা পার হইতে হইবো তাই ৫ মিনিট দেরী হইতে পারে।
- আচ্ছা।

ফোন রাখতে রাখতেই শহীদের কল,
- ভাই, একদম টেনশন কইরেন না, ঘটনা বাসা পর্যন্ত যাইতে দিমু না, কিছু  টাকা ম্যানেজ করে আসতাছি। আর কারো নাম কন নাই তো? প্লিজ ভাই!
- আরে নাহ্! রাখছি তাহলে।

কয়েক গজ দূরে উৎসুক জনতার ভীড় বাড়ছে, ফিস্-ফাস্ টের পাচ্ছি।
প্রথমজন পুড়িয়াটা হাতে নেয়, ধীরে ধীরে খুলে এক পলক তাকিয়ে হাত মুখের সামনে তোলে, অন্য হাতের দু'আঙ্গুলে ঘসে জিজ্ঞেস করে,
- কী এইটা?
- দেখেন না কি?

অতিভাবের জন স্বজোড়ে জিজ্ঞেস করে,
- মানে?

উত্তরের অপেক্ষা না করে নিজের হাতে সেও পরখ করে। চেহারার অভিব্যক্তি দ্রুত বদলে যায়! আমার দিকে তাকিয়ে বলে,
- আগে বলবেন না! অযথা সময় নষ্ট করলাম, আমরা দুঃখিত।
- ইটস্ ওকে। আমার প্রেমিকা দেখলেও এমনি ভাবতো।

হাসানের কল,
- দাদা, আজ তো তোমার কাছে কিছু নাই! তো পুলিশ ধরছে ক্যান?
- স্টেজে ওঠার আগে তুই যে অবশিষ্ট জরির পুড়িয়া'টা আমার পাঞ্জাবির পকেটে রেখেছিলি, ওটাকে অন্যকিছু ভাবছিলো। সব ঠিক হয় গেছে, তোদের আর আসতে হবে না।

টকবক,টকবক,টকবক

৭৪ পেড়ুনো জমিলা টকবক, টকবক বলতে বলতে হঠাৎ বোকাবনে যায় নিজের বোকামি দেখে! তার নাতি রইসউদ্দীন ঘুমে আধমরা, তিনি অযথা টকবক-টকবক করে গেছেন!

নাতির কেবল যুবরাজের কিচ্ছা ভাল্ লাগে। প্রতাপশালী রাজার পুত্র, দেখতে সুদর্শন, রাগ আর কোমলতায় মেশানো ব্যক্তিত্ব, তার জন্যে পাগল রাজকন্যারা, অন্যরা দেখলেও ধন্য মনে করে নিজেদের, তার উদীয়মান বীরত্বের কথা অবগত সবাই!
জমিলা মনে মনে ছুটির কথা ভাবে। একদিন রইস্ আরো বড় হবে, জমিলা আর ঘুমে প্রায় ভেঙ্গে পড়া চোখ নিয়ে রাজপুত্রদের কিচ্ছা শোনাতে হবে না, ইচ্ছেমাফিক ঘুমাতে পারবে! আবার তার মনে হয়, এই বাৎসল্যের সুখটা তো তখন আর পাওয়া যাবে না।
যুবরাজের কিচ্ছাশোনা রইস্ কৈশরে এসেই ধাক্কা খায় বাস্তবতার। দেখে অনেক কোটালপুত্রের মতো সে, অন্য ক'জন রাজপুত্র প্রায়! মনটা ভেঙ্গে ফাঁক হয়ে থাকে! গোটা কৈশর পেড়িয়ে যৌবনের মাঝখানে এসেও দেখে কোটাল পুত্রই সার! অনেক-অনেক হিসেব কষে শেষে সে বোঝে- 'যুবরাজ' এক অসম্ভব কল্পনা!
ভেঙ্গে পড়া ভাবনার আকাশ ভারী কোরে তোলে তার মাথা, একদিন সহ্যাতীত হয়ে পড়ে আচমকা!
অচেনা বসন্ত বয়ে যায় আটবার। এক ভোরে বাজারের লোকজন দেখে- একটি বাঁধা গাধার পাশে শুয়ে এক পাগল প্রায় মানুষ!
বেলা বাড়ে, আশেপাশের গ্রামে রটে যায়, শেষে আবিস্কৃত হয়, এই পাগল প্রায় লোকটি 'রইসউদ্দীন'।
রইস্ চিনতে পারে অনেককেই, যেচে কথা বলে না, উত্তরও দেয় অল্প কথায়, তাও কখনো সখনো। 
পরিবারের লোকজন বাড়িতে নিয়ে যায়। ইচ্ছেমাফিক কাজে সহায়তা করে চুপচাপ থেকে। কারো সাথে মেশে না। ভোর থেকে বিকেল কাজ করে কতোকিছুই। গোসল, খাওয়া সেড়ে ঢুকে পরে ছোট্ট ঘরে। সন্ধ্যার পর তার গাধার পিঠে চড়ে বেড়িয়ে পড়ে ইচ্ছে মতো। একেকদিন একেকদিকে, কোনো কোনো পথে টানা কয়েকদিন... !  আশাপাশের সবাই জানে 'টকবক' শব্দের উৎস।
পরিচর্যাহীন দাঁড়ি-ঘোঁফ-চুলের তমাটে প্রায় বর্ণের আধপাগল রইসউদ্দীন যাচ্ছে গাধা ছুটিয়ে। রইস্ গাধার পিঠে ওঠেই ভুলে যায় অন্যকিছু! তার দাদীর মুখে শোনা যুবরাজের কিচ্ছা ছাড়া যেনো আর কিছু নেই! রইসউদ্দীনের ভেঙ্গে চৌচির মন যুবরাজ হয়ে ওঠে তখন! প্রতাপশালী রাজারপুত্র, দেখতে সুদর্শন,,রাগ আর আর কোমলতায় মেশানো ব্যক্তিত্ব, তার জন্যে পাগল রাজকন্যারা, অন্যরা দেখলেও ধন্য মনে করে নিজেদের, তার উদীয়মান বীরত্বের কথা অবগত সবাই!

রইসউদ্দীন গাধার পিঠে ছুটছে টকবক, টকবক, টকবক, টকবক...।


সুদীপ রায় সুমন
মাতা- রিনু রানী রায়
পিতা- সুহাস রঞ্জন রায় 
ঠিকানা- ৩৫/১/১ বলাশপুর নয়া পাড়া, সদর, ময়মনসিংহ। 
কর্মক্ষেত্র- বাংলাদেশ বেতার, ময়মনসিংহ কেন্দ্র।
মুঠোফোন-  +৮৮ ০১৭১৮২৪৫০৪৫
ই-মেইল-  rsudip787@gmail.com

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

আজকের আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url