গল্প রাত প্রহসন - লেখক কাশবন কবি

 রাত হলেই জানালাটা খুলে দিই আমি ।

দিনের বেলায় বন্ধ করে রাখলেও রাতের

বেলাতে জানালাটা কখনো বন্ধ করিনা ।

শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা জানালার ডালা দুটো

রাতের বেলা খোলাই থাকে । শীতকালে

রাতের বেলায় হুহু করে কুয়াশা আসে

জানালা দিয়ে । আমি কুয়াশা ভেদ করে

বাহিরের অন্ধকার দেখি। দেখি বললে ভুল

হবে , দেখার প্রাণান্ত চেষ্টা করি ।

বাড়ির পেছনের জামগাছের পাতাগুলো মৃদু

আন্দোলন করে শৈত্যপ্রবাহের তাড়নায় ।

আমি ঠান্ডা টের পাইনা । অনুভূতি

রিনরিনে হতে হতে ভোঁতা হয়ে গিয়েছে

বোধহয় । নইলে টের পেতাম ।

আপনাকে একটা ছেলের গল্প বলি ।

ছেলেটা আমার মতোই বয়সী । প্রেম করতো

একটা মেয়ের সাথে যে কিনা তার সাথেই

পড়তো । সারাদিন কলেজে হৈ-হুল্লো ,

মাঝে-সাঁঝে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে শহরের

আলিগলিতে ঘুড়ে বেড়ানো..কিংবা

সিনেমার টিকিট কেটে সবার চোখ

বাঁচিয়ে বসে সিনেমা দেখা চলতো । আর

রাত হলে রাতভর মেয়েটার সাথে কথা

বলতো । ছেলেটা টিফিনের টাকা

বাঁচিয়ে ফোনে কথা বলতো । খুব বেশীক্ষন

কথা এভাবে বলা যেতোনা । বড়জোর

একঘন্টা , তারপর ছেলেটা ছটফট করতো

কথা বলার জন্য ।

ছেলেটা তখন স্যারের কাছে যাওয়া বন্ধ

করে দিলো টাকার জন্য , সেই টাকায়

রাতভর ফোনালাপ । ফলাফল যা হবার তাই

হলো । ছেলেটা পরীক্ষায় খারাপ করলো ।

কি এসে যায় ! তার তো একজন আছেই !

তাকে আর ওসব নিয়ে ভাবতে হবেনা । তার

সেই ‘একজন’ এর বেলায় সেটা হয়নি । সে

ফলাফল ভালো করলো । তারপর দেশের

নামকরা একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে চ্যান্স

পেলো । ছেলেটা মফস্বলের একটা

কলেজেই ভর্তি হলো ।

ছেলেটার আফসোস নেই । তার ‘সে’ থাকলে

আর কোনকিছুরই দরকার নেই ।

ছেলেটা এই নিয়েই বেশ খুশী ।

এখন মেয়েটা ছেলেটার কাছ থেকে অনেক

দূরে থাকে । দূরে বলতে অনেক দূরে ।

কুমিল্লা থেকে ঢাকার দূরত্ব তিনঘন্টার

যাত্রাপথ ।

কথা হয় রাতভর ফোনে । এখন অবশ্য রাতভর

হয়না । মেয়েটা প্রায়ই ব্যাস্ত হয়ে যায় ।

তার ফোন আসে ফ্রেন্ডের কিংবা

ফ্যামিলির কারোর । প্রায়ই ফোন রেখে

দিতে হয় তাড়াতাড়ি । মেয়েটার সকালে

ক্লাস থাকে । মাঝে-সাঁঝে রাতে কথাও

হয়না । মেয়েটার কাল পরীক্ষা । রাতভর

পড়াশুনা করতে হবে যে !

ছেলেটা হাসফাস করে দম আটকে ।

ফোনের স্ক্রীনে নাম্বারটা তোলা হলেও

ডায়াল করেনা । তার তিরুর যে কাল

পরীক্ষা !

*

তিরু আজকাল একটু বেশী ব্যাস্ত থাকে ।

একটু বেশী ই । কথা বলার মাঝখানে হুট

করে বলে , ‘এই দাড়া একটা ফোন এসেছে ,

পাঁচ মিনিট’

আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন

রেখে দেয় । তারপর ঘড়ির কাটায় পাঁচ দশ

পনেরো পঁচিশ পয়তাল্লিশ ষাট গড়িয়ে

সত্তরে যেয়ে পাঁচ মিনিটের অবসান হয় ।

ছেলেটার মাথায় আগুন ধরে যায় । কীসের

অতো কথা ওর ? ও কেবল আমার সাথে কথা

বলবে ।

‘এই তোর কীসের এতো কথা মানুষের

সাথে ? এখন থেকে তুই শুধু আমার সাথে

কথা বলবি...’

ওপাশে তিরু কাঁদে । কান্নার দমকে তিরুর

চোখের পাতা তিরতির করে কাঁপে ।

ফোপানির শব্দ শুনতে পায় ছেলেটা ।

‘ভালোবাশি তোকে...’

ছেলেটা চুপ হয়ে থাকে । সমস্ত রাগ পানি

হয়ে যায় মূহুর্তেই । পাগলের মতো আওড়ে

চলে ‘ভালোবাশি..ভালো

বাশি...ভালোবাশি’

তিরু ফোপানি থামায় ।

কথা শেষ হয়ে যায় তখনকার মতো ।

শুভরাত্রি বলে শুয়ে পড়ে ।

ছেলেটার ঘুম আসেনা । তার আরো একবার

তিরুর মুখে ভালোবাশি শুনতে ইচ্ছে হয় ।

তিরুর নাম্বারে ডায়াল করেই মেজাজ

বিগড়ে যায় ।

‘দ্যা নাম্বার ইউ আর কলিং ইজ বিজি নাও’

একের পর এক ডায়াল করতেই থাকে ।

একঘন্টা-দুঘন্টা করে রাত শেষ হবার দিকে

চলে । ছেলেটা পাগলপ্রায় হয়ে হাতের

ফোনটা দেয়ালে সজোরে আছড়ে মারে ।

শক্ত ইটের দেয়ালে লেগে ফোনটা টুকরো-

টুকরো হয়ে যায় । ছেলেটার রাগ কমেনা ।

সামনের টেবিলটা সজোরে সামনের দিকে

ঠেলে দেয় । টেবিলটা উল্টে যেয়ে

উপরের সব ছিটকে পড়ে । কাঁচের গ্লাস

মেঝেতে পড়ে চুরমার হয় । তারপর হাটতে

যেয়ে পা কেটে রক্তারক্তি হয় । রক্তে

লাল হয়ে যায় ঘরের মেঝে...

*

পাঁচদিন ধরে তিরুর সাথে কথা হয়না ।

ছেলেটা বদ্ধ ঘরে হাসফাস করে তিরুর

শ্বাসের অভাবে । মুঠোফোনে তিরুর

নিঃশ্বাস প্রাণ বইয়ে দিতো বোধহয় ।

ছেলেটা পাগলপ্রায় হয়ে ভাঙা ফোন

থেকে সিমকার্ড নিয়ে অন্য ফোনে লাগায়

। তিরুর নাম্বারটায় ডায়াল করে । বন্ধ !

তিরু ফোন অফ করে রেখেছে !

ছেলেটা তখন শিমুর কাছে ফোন দেয় । শিমু

তিরুর বান্ধবী । একই হোস্টেলে থাকে ।

‘আমাকে চিনেছেন ? আমি ইমন...কুমিল্লা

থেকে ..আরে ওইযে তিরুর কেউএকজন

আরকি’ ফোনের এপ্রান্তে লাজুক হাসে

ছেলেটা ।

‘আচ্ছা তিরুর ফোনটা অফ কেনো বলতে

পারেন ?’

ওপাশ থেকে মেয়েটা কিছু বলে ।

ছেলেটার মুখটা কালো হয়ে যায় ।

‘আচ্ছা আপনি আমাকে তিরুর ঠিকানাটা

দিতে পারেন ? আমি এর আগে কখনো

ঢাকায় যাইনি...’

তারপর খসখস করে খাতায় কিছু একটা

লিখে নেয় । রাতটা কোনক্রমে কাটিয়ে

দেয় ।

তারপর সকল হবার আগেই বেরিয়ে পড়ে ।

ঘড়ির কাটা আটে যাবার আগেই ছেলেটা

ঠিকানা মত পৌঁছে যায় ।

শহুরে মানুষের জীবনে তখনো ব্যাস্ততার

আঁচ লাগেনি । কারণ সকাল আটটা মানে

সদ্য সকাল হলো বলে !

ছেলেটা হোস্টেলের গেইটে বসে থাকে ।

শিমুর কাছে ফোন দেয় , ফোনটা রিসিভ

হয়না ।

একবার..দুবার..চারবার দিয়েই যায় দিয়েই

যায় । ওপ্রান্তে সাড়া মেলেনা ।

গেট দিয়ে কেউ বের হলে তার কাছে

জানতে চায় ।

‘এইযে আপু , আপনি তিরুকে চেনেন ? ফার্স্ট

ইয়ার জীববিজ্ঞান বিভাগের...গোলগাল

চেহারা ঠোটের কোনে একটা

তিল...পিচ্চি পিচ্চি ?...’

না সূচক জবাব আসে । এই হোস্টেলের দুশো-

চার নাম্বার রুমে তিরু নামের কেউ

থাকেনা ।

ছেলেটা অপেক্ষা করে । হোস্টেল

মেইনটেইন্যান্স এ যে মহিলা আছে সে

আসবে দশটায় । এখনো দেড়ঘন্টা বাকী ।

ছেলেটা বসেই থাকে । কিছুক্ষন পর একজন

এসে বলে যায় আজকে মহিলা আসবে না ।

ছেলেটা নিরুপায় হয়ে ঘুরতে থাকে । এর

কাছে ওর কাছে জিজ্ঞেস করে করে

তিরুর ক্লাসের কাছে চলে যায় ।

যাক..ওখানে না থাকলেও এখানে তো

আছে..ও নিশ্চই এখানে ক্লাস করতে আসবে

‘এইযে ভাইয়া ফার্স্ট ইয়ারের ক্লাস

কোনটা ?’

আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় । যার কাছে

জানতে চেয়েছিলো তার চোখে প্রশ্ন ।

ছেলেটাকে কিছু বলার আগেই হেটে যেয়ে

ক্লাসরুমের সামনে বসে থাকে ।

যেখানটায় বসে সেখানটায় রোদ পড়েছে

বেশ । পাশে ছায়া থাকলেও সেখানটায়

না বসে ছেলেটা ইচ্ছে করেই রোদের

ভেতর বসে । পাছে ছায়ায় বসলে তিরু

তাকে দেখতে না পায় !

কিন্তু তিরু আসেনা । আরেকজনের কাছে

প্রশ্ন করে জানতে পারে ফার্স্ট ইয়ারের

পরীক্ষার রুটিন দিয়েছে বলে ওদের ক্লাস

ক্যান্সেল । আজ ক্লাস হবেনা ।

ছেলেটা দাড়িয়েই থাকে । নড়েনা এক

চুলও । ফোনটা বের করে শিমুকে ফোন দেয়

। এবারে ফোনটা রিসিভ হয় ।

কিছুক্ষন পর শিমু আসে ।

‘ওর ফোন বন্ধ কেনো আর ও আছে কোথায়

বলতে পারেন ? আর আশ্চর্য ও রোকেয়া

হলে থাকেনা তার পরেও বললেন আপনি ও

ওখানে থাকে !’

‘ইমন সাহেব..আপনি আসলে বোকা । তিরু

ওখানেই থাকে । ও আপনার সাথে দেখা

করবেনা বলে মেয়েটাকে পাঠিয়েছিলো

আপনাকেও যেনো যেয়ে বলে আসে ও

ওখানে থাকেনা । আর আমাকেও বলতে না

করেছে এই কথা । বললে আমার সাথে

বন্ধুত্ব রাখবেনা এও বলেছে । আপনি ওর

জন্য বসে না থেকে চলে যান...’

ছেলেটা হা করে শিমুর মুখের দিকে

তাকিয়ে থাকে । কিছু বলেনা । শিমু উঠে

চলে যায় । ছেলেটা বসেই থাকে ।

ছেলেটার তখন মনে হয় ওর বোধহয় বোধ নেই

কি হচ্ছে এসব!

*

আমার কেনো যেনো ঠান্ডা লাগছে হুট

করেই । খুব বেশী না অল্প একটু । গায়ে

কাঁপন এলো বোধহয় । ব্যাস্ত শহরের

রাস্তাগুলো ততক্ষনে জীবন্ত হতে শুরু

করেছে । আলো না ফুটলেও দু-একটা বাস

চলতে শুরু করেছে । মনে হচ্ছে বহু দূর থেকে

গাড়ির গুরুগম্ভীর শব্দ ভেসে আমার কানের

ভেতরে প্রবেশ করছে । তেষ্টা পাচ্ছে খুব ।

সামনের টেবিলে জগ ভর্তি পানি আর

সাথে মগ রাখা আছে , টেনে নিলেই হয় ।

আমার ইচ্ছে হয়না । বুক ফেটে যায়

তেষ্টায় । আমি তেষ্টা নিয়েই বসে থাকি

। আমার আসলে কিছুই হয়না । ও

হ্যা...আপনাকে গল্প বলছিলাম একটা ।

আচ্ছা আপনি কি মনযোগ দিয়ে শুনছিলেন ?

বোধহয় না । শুনলে ছন্দ পতন হতোনা

মোটেও ! এই খানটায় আসতে ছন্দপতন হলো

কতোবার !

আমি আসলে কেমন যেনো । একটা গল্পও

ঠিকঠাক বলতে পারলাম না , জড়িয়ে

গেলো ! বাহিরে আলো ফোটেনি এখনো ।

গল্পটা অসমাপ্ত রইলো বোধহয় .. তাইনা ?

থাকুক না ! সবার গল্পের কি আর পরিণতি

থাকে ?

আপনার কি এখন জানতে ইচ্ছে হচ্ছে

ছেলেটা কে? ছেলেটা এখন কোথায়?

তিরুর চোখের পাতা এখন কি আর তিরতির

করে কাঁপে? আমার রাতগুলোই বা এতো

প্রহসন কেনো করে আমার সাথে?

থাকুক অজানা। সব কথা জানতে নেই ,

জানতে চাইতেও নেই। রাতেরা প্রহসনরত

থাকুক আমার সাথে অজ্ঞাত কারণে। কোন

একদিন সন্ধি হবে আমার । রাতের

সাথে, জীবনের সাথে ।

‘আমি প্রায়ই জ্বলে যাই ,

জলের উপর দাড়িয়ে থেকেও যাই পুড়ে

যাই !

রাত্রি এলে একেলা বেলায় নেই হয়ে যাই

খুব ;

তোমার দেয়া যাতনা দেখে , অশ্রু মেখে ,

বেলা-অবেলায় একেলা আমি, যাই হয়ে

যাই চুপ...’।


ছদ্মনাম:কাশবন কবি
বাবা:মিজানুর রহমান 
মা:জিনাত রেহানা
পড়াশোনা: এম. এ 
শখ: ভ্রমন, লেখালেখি, 
ভালোবাসি জলরাশি দেখতে। 


থানা/গ্রাম/এলাকাঃ- পূর্বধলা (মঙ্গলবাড়িয়া)
জেলাঃ- নেত্রকোনা


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

আজকের আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url