ছোটগল্প: অদৃশ্য কলম হাতে


নিরুপমার সাথে আমার পরিচয় কখন, কোথায়, কীভাবে তা মনে পড়ে না। তবে রাজনৈতিক আড্ডা, মিছিল কিংবা কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মহড়ায় এটুকু নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি। সম্পর্কে নিরুপমা আমার কে হয় তা যেমন নির্ধারণ করা সম্ভব হয় নি, এই ধরণের সম্পর্ককে ব্যাখ্যা করার মতো বিশেষ্য বা বিশেষণও খুঁজে পাইনি।


আমরা কথা বলতাম, অনেক কথা। কথার শুরুতে কথা, কথার শেষে কথা, কথার মাঝে কথা। আমরা যখন কথা বলতাম, তখন ফেসবুকের এতটা চল হয়নি। সামনাসামনি কথা বলতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতাম। আর রাত ১২ টার পর বিশেষ অফারে রাতভর চলতো কথা। কী কথা এত? মনে নেই। আমরা স্বপ্ন দেখতাম, স্বপ্ন তৈরি করতাম, স্বপ্নকে আকৃতি দিতাম, স্বপ্নকে জীবন্ত করতে স্বপ্ন দেখতাম।


তারপর? কেটে গেছে বহুদিন। আমি নিরুপমার ব্লকলিস্টে নাকি নিরুপমা আমার ব্লকলিস্টে সে খোঁজ নেবার সাহসটুকু আমার হয়নি। আমাদের অদ্ভুতুড়ে সম্পর্কের কথা জেনে নিরুপমার মা আমার জাতপাত তুলে যেভাবে গালি দিয়েছিলেন সেটা ভুলে গেলেও, ভুলিনি নিরুপমার মায়াবী মুখটা। 


আমরা একই শহরের নিবাসী ছিলাম।দুইবার আমাদের ভাড়া বাসায় ভাড়াটে গুণ্ডারা তাণ্ডব চালিয়েছে, নিরুপমাদের শহর থেকে তাই চলে এসেছি। বহুদূরে নয়, কিছুদূরে। 


আমরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করতে অনেক চিঠিও লিখতাম। শহরে পড়তে আসার সুবাদে মেসে থাকতাম, মেসের ঠিকানাতেই আসতো ছোটছোট অক্ষরে লেখা চিঠি।


সেদিন বৃষ্টি হচ্ছিলো, বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে আমরা বসে ছিলাম একে অপরের দিকে চেয়ে। হঠাৎ নিরুপমা তারবাম হাত দিয়ে আমার ডান হাত স্পর্শ করে বললো, "চলো একটা খেলা খেলি। আমি তোমাকে কিছুদিন পরপর তিনটা চিঠি লিখবো ঠিকানা ছাড়া। শুধু তোমার নাম থাকবে খামের উপর। তুমি যদি চিঠিগুলো পাও তবে জানবো আমরা আমাদেরকে ভালোবাসি। আর যদি না পাও, তাহলে জানবো আমরা কেউ কাউকে ভালোবাসি না। খেলবে?" 


আমি অট্টহাসিতে ফেটে পড়েছিলাম সেদিন। এ আবার কেমন খেলা! আমার সে হাসিতে মৌনসম্মতি খুঁজে পেয়ে পরপর তিনটি চিঠি লিখেছিলো সে।


প্রথম চিঠি-

ডাকপিয়ন আমার পরিচিত ছিলেন কিন্তু আমার নাম জানতেন না! আমরা একসাথে সিগারেট টানতাম মাঝেমধ্যে। একদিন আলাপের এক ফাঁকে হঠাৎ বললেন, তিনি এক মহা বিপদে পড়েছেন। বিপদটা হলো তিনি একটা চিঠি পেয়েছেন যেটাতে শুধু প্রাপকের নাম লেখা, কোনো ঠিকানা নেই। আমি বেশ কৌতূহলী হলাম।  তাকে জিজ্ঞেস করলাম, "প্রাপকের নাম কী নিসর্গ?" তিনি অবাক হয়ে গেলেন, জানালেন হ্যাঁ, প্রাপকের নাম নিসর্গ! একই সাথে সেদিন তিনি আবিষ্কার করলেন আমার নামই নিগর্গ। সেদিনের চা, সিগারেটের বিলটা আমি দিলেও আর কিছু খোলাসা করে বলিনি তাকে। চিঠি পাবার ঘটনা চিঠি লিখেই জানিয়েছিলাম নিরুপমাকে।


দ্বিতীয় চিঠি-

এবার নিরুপমা প্রাপকের নাম বদলে আমার ডাক নাম লিখে দিলো, যে নামটা সেই দিয়েছিলো। আমার মেসের রুমমেটরা আমার চিঠি আদানপ্রদান আর অদ্ভুতুড়ে সম্পর্কের কথা জানতো। দ্বিতীয় চিঠিটা পড়েছিলো অন্য আরেকজন ডাকপিয়নের কাছে। সেই ডাকপিয়ন তো রেগেমেগে আগুন, এত ঝামেলা কেন করে মানুষ? এটা কী কোনো মজা করার বিষয়? ঘটনাক্রমে আমার এক রুমমেট জানতে পারে এমন চিঠি সম্পর্কে এবং ধরে নেয় চিঠির প্রাপক আমিই। পরে সে গিয়ে নিয়ে আসে আংশিক বেনামি চিঠিখানা। আমার সেই ডাক নাম সে জানতো না, তবুও সে খুবই আত্মবিশ্বাসী ছিলো যে চিঠিটা আমারই! দ্বিতীয় চিঠি প্রাপ্তির খবরও নিরুপমার অজানা রইলো না।


তৃতীয় চিঠি-

মাসখানেক পর আমি নিজেই পোস্ট অফিসে গেছি,খাম কিনতে আর চিঠি পোস্ট করতে। কাকতালীয়ভাবে তখনই আনডেলিভারেবল চিঠি বা বেনামী চিঠিগুলো আলাদা করে ফেলে দেবার জন্য রাখা হচ্ছিলো। পোস্ট মাস্টারের হাতের চিঠিটা একটু সচেতনভাবে খেয়াল করে দেখলাম প্রাপকের জায়গায় লেখা "নিসর্গ"। অনেক অনুরোধ করে চিঠিটা নিলাম তার কাছ থেকে, বকাঝকাও করলেন। বললেন এমন ছেলেমানুষির কোনো মানে হয় না। তবে আমি পুলকিত হলাম। 


তৃতীয় চিঠি প্রাপ্তির কথা বলা হয়নি নিরুপমাকে, তার আগেই আমরা যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছি। মাঝেমাঝে মনে হয়, বলে দিই। কীভাবে বলবো? ওর ফোন নম্বরটা টাইপ করে পরেক্ষণেই মুছে ফেলি, সাহস হয় না। শুনেছি নিরুপমা ভালোই আছে স্বামী, সন্তান নিয়ে। আমিও তো ভালোই থাকি রোজ। একমাত্র সন্তান হিসেবে বাবা-মা এখনও বিয়ের জন্য পিড়াপিড়ি করছে, মেয়ে দেখছে। আমার বড্ড জানতে ইচ্ছা করে, তিনটা চিঠিই তো আমি পেয়েছি। তবে কী আমরা আমাদেরকে ভালোবাসতাম না? ভালোবাসি না? কিংবা ভালোবাসবো না?

-জুবায়ের ইবনে কামাল

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

আজকের আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url